SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

সপ্তম অধ্যায়

ধর্মগ্রন্থে নৈতিক শিক্ষা

ধর্ম শব্দটির অর্থ, ‘যা ধারণ করে। ধৃ ধাতু + মন্ (প্রত্যয়) ধর্ম । ধৃ ধাতুর অর্থ ধারণ করা । যা হৃদয়ে ধারণ করে মানুষ সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও পবিত্র জীবনযাপন করতে পারে, তাকেই বলে ধর্ম। মানবজীবনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ এবং নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য বিভিন্ন উপদেশ, নির্দেশ রীতিনীতি, আখ্যান-উপাখ্যান যে-গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে, তাই ধর্মগ্রন্থ। ধর্মের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক শ্রদ্ধা রয়েছে এবং ধর্মগ্রন্থের প্রতিও সকলেরই শ্রদ্ধা-ভক্তি রয়েছে । আর এজন্যই মানুষ ধর্মগ্রন্থ পাঠ অথবা শ্রবণ করা ধর্মের অঙ্গ বলে মনে করে ।

ধর্মগ্রন্থে ধর্মতত্ত্ব, ধর্মাচার, ধর্মীয় সংস্কার, ধর্মানুষ্ঠান অনুকরণীয় উপাখ্যান প্রভৃতি সন্নিবেশিত থাকে । কাজেই আদর্শ জীবনাচরণ ও নৈতিকতা গঠনে ধর্মগ্রন্থের বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। এই ধর্মগ্রন্থগুলো হলো বেদ, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত প্রভৃতি। এ অধ্যায়ে উপনিষদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, উপনিষদের গুরুত্ব ও শিক্ষা, উপনিষদ থেকে একটি উপদেশমূলক উপাখ্যান ও তার শিক্ষা উপস্থাপন করব। একই সঙ্গে রামায়ণ ও মহাভারতের শিক্ষাও সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করব ।

 

এ অধ্যায় শেষে আমরা -

  • হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আদর্শ জীবনাচরণ ও নৈতিকতা গঠনে ধর্মগ্রন্থের গুরুত্ব ও ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারব
  • ধর্মগ্রন্থ হিসেবে উপনিষদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বর্ণনা করতে পারব
  • ধর্মাচরণ ও নৈতিকতা গঠনে উপনিষদের গুরুত্ব ও শিক্ষা ব্যাখ্যা করতে পারব 
  • উপনিষদের একটি উপাখ্যান ও এর শিক্ষা বর্ণনা করতে পারব
  • ধর্মাচরণ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা গঠনে রামায়ণ ও মহাভারতের শিক্ষা ব্যাখ্যা করতে পারব 
  • রামায়ণ-মহাভারতে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা গঠন সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হব।

 

 

 

 

 

 

পাঠ ১ : আদর্শ জীবনাচরণ ও নৈতিকতা গঠনে ধর্মগ্রন্থের গুরুত্ব ও ভূমিকা

মানুষ জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধিতে সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের লব্ধজ্ঞান হাজার হাজার বৎসর ধরে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় চলে আসছে। তারপর লিপি আবিষ্কারের পর ধীরে ধীরে এ সমস্ত জ্ঞান গ্রন্থাকারে সন্নিবেশিত হয়েছে। বেদ, উপনিষদ পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে মানুষের কল্যাণে ঐশ্বরিক তত্ত্ব, ইহলোক ও পরলোকের কথা, শ্রেয় ও প্রেয়র কথা, নানা আখ্যান ও উপাখ্যানের মাধ্যমে মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজা-রাজবংশের কথা, সৃষ্টিতত্ত্ব, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে নানা রহস্যের কথা আলোচনা করা হয়েছে। বেদ হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ । তাই হিন্দুধর্মকে বৈদিক ধর্ম বলা হয়। বেদকে আশ্রয় করেই হিন্দুধর্মের বিকাশ।

এর পূর্বে আমরা ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য অবগত হয়েছি । বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কেও কিছু কিছু তথ্য জেনেছি । আমাদের সকলেরই ধর্ম মেনে চলা উচিত। মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব । যার মনুষ্যত্ব নেই, সে পশুর সমান। ধর্ম পালন করলে পশুপ্রবৃত্তির বিনাশ ঘটে। জেগে ওঠে মানবিকতা ও পবিত্রতার এক বিশুদ্ধ কল্যাণ অনুভূতি । এ কল্যাণবোধই ধর্ম । আমরা জানি, মনুসংহিতায় বেদ, স্মৃতি, সদাচার এবং বিবেকের বাণী এ চারটিকে বলা হয়েছে ধর্মের বিশেষ লক্ষণ-

‘বেদ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ ।

এতচ্চতুর্বিধং প্রাহুঃ সাক্ষাৎ ধর্মস্য লক্ষণম্ ॥' (মনুসংহিতা, ২/১২)

অর্থাৎ বেদ, স্মৃতি, সদাচার ও বিবেকের বাণী এ চারটি ধর্মের বিশেষ লক্ষণ । বেদে বিশ্বাস রেখে স্মৃতিশাস্ত্রের অনুশাসন মেনে এবং মহাপুরুষদের আচরিত কার্যক্রম তথা সদাচার থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবনে চলতে হয়। আর এতেও যদি সমস্যার সমাধান না হয় তখন নিজের বিবেকের দ্বারা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কাজে লাগাতে হয় নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কর্তব্য-অকর্তব্যের জ্ঞানকে ।

একক কাজ : ধর্মের লক্ষণ কয়টি ও কী কী ? লেখ ।

মনুসংহিতায় ধর্মের আরও দশটি বাহ্য লক্ষণের কথা বলা হয়েছে যার মধ্যে ধর্মের স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে :

‘ধৃতিঃ ক্ষমা দমোহস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়-নিগ্রহঃ।

ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধো দশকং ধর্মলক্ষণম্ ।'

অর্থাৎ সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, দয়া, চুরি না করা, শুচিতা, ইন্দ্রিয় সংযম, শুদ্ধ বুদ্ধি, জ্ঞান, সত্য এবং ক্রোধহীনতা এ দশটি লক্ষণের মধ্য দিয়ে ধর্মের স্বরূপ প্রকাশ পায় । সব কিছুর মূলে ঈশ্বর । সুতরাং ধর্মের মূলও ঈশ্বর । ঈশ্বরকে ভক্তি করা ধর্মের মূল কথা। ঈশ্বরের নির্দেশিত পথে চলা সকলেরই কর্তব্য। যা ধর্মের বিপরীত তাই অধর্ম । যেমন চুরি না করা ধর্ম । সুতরাং চুরি করা অধর্ম । অতএব চুরি করা উচিত নয় । কারণ এতে অধর্ম হয়। অধর্ম নৈতিকতা-বিরোধী । ধর্ম নৈতিক শিক্ষার সহায়ক ।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা ধর্ম ও অধর্ম সম্পর্কে যে ধারণা লাভ করেছি এ সমস্ত কিছুই ধর্মগ্রন্থে বিশদভাবে লিপিবদ্ধ আছে। ধর্মগ্রন্থে আছে বিভিন্ন কাহিনি বা উপকাহিনি, আখ্যান-উপাখ্যান। আর এ সমস্ত বর্ণনাতে

 

 

 

দেখানো হয়েছে কীভাবে ধর্মের জয় হয় আর অধর্ম কীভাবে পরাজিত ও বিনাশপ্রাপ্ত হয় । ধর্মগ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে কী করলে মানবের কল্যাণ হবে, কী করলে নৈতিক উন্নতি হবে । আর একথাও বর্ণিত হয়েছে কীভাবে মানুষ নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আদর্শ জীবন ও নৈতিকতা গঠনে ধর্মগ্রন্থের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তাই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে আমরা আমাদের জীবনকে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী করে গড়ে তুলব । এভাবেই আমাদের সমাজ তথা জাতি ও দেশ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ ।

একক কাজ : ধর্মের যে দশটি বাহ্য লক্ষণের কথা বলা হয়েছে, তা লেখ ।

পাঠ ২ : উপনিষদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

আমরা বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা, শ্রীচণ্ডী প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের পরিচয় জেনেছি । এবার আমরা বৈদিক সাহিত্য থেকে উপনিষদ নিয়ে আলোচনা করব । উপনিষদ

‘বেদ’ একটি বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার । বিশ্বের প্রাচীন ইতিহাস জানতে হলে বেদই একমাত্র নির্ভরযোগ্য সহায়ক

গ্রন্থ । বেদ এক অখণ্ড জ্ঞানরাশি, যা দ্বারা মানবজাতি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ, এই চতুর্বর্গের সন্ধান লাভ

করতে পারে । প্রকৃত পক্ষে ভারতবর্ষের শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্ম-কর্ম, আচার-নিষ্ঠা, সবই এই বেদের মধ্য দিয়ে

প্রতিভাত হয়েছে । মনুসংহিতায় লিখিত হয়েছে, ‘বেদঃ অখিলধর্মমূলম্’- অর্থাৎ ‘বেদ ধর্মের মূল ।'

বৈদিক সাহিত্য বলতে সাধারণত চার প্রকার ভিন্ন ধরনের অথচ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত রচনার সমষ্টি বোঝায় । যেমন- (১) মন্ত্র বা সংহিতা, (২) ব্রাহ্মণ, (৩) আরণ্যক ও (৪) উপনিষদ। এ রচনা সমষ্টিকে দুইটি কাণ্ডে বিভক্ত করা হয়েছে; যথা- (ক) কর্মকাণ্ড ও (খ) জ্ঞান কাণ্ড । কর্মকাণ্ডে আছে মন্ত্র, যাগ-যজ্ঞ, অনুষ্ঠান, আচার-নিয়ম পালনের নির্দেশনা । আর জ্ঞান কাণ্ডে রয়েছে ঈশ্বরের কথা, ব্রহ্মের কথা, সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি রহস্যের কথা । উপনিষদ এই জ্ঞান কাণ্ডেরই অংশ । ব্রহ্মকে নিয়ে এ গ্রন্থে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে । ব্রহ্মবিদ্যা গুহ্যতম বিদ্যা যা মানুষের জন্ম-মৃত্যুর কারণ নিয়ে আলোচনায় ভরপুর । জন্ম আর মৃত্যু মানুষের নিকট এক বিরাট রহস্য । তাই উপনিষদকে রহস্য বিদ্যাও বলা হয় । উপ-নি- ণ সদ্ যোগে ক্বিপ্=উপনিষদ্ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ‘উপ’ অর্থ-সমীপে’, নি' অর্থাৎ নিশ্চয়ের সাথে, সিদ্ অর্থাৎ বিনষ্ট করা, সুতরাং সামগ্রিক অর্থ দাঁড়ায় গুরুর নিকট উপস্থিত হয়ে নিশ্চয়ের সাথে যে গুহ্যবিদ্যা শিক্ষাদ্বারা অবিদ্যা প্রভৃতিকে বিনাশ করে তাই উপনিষদ । উপনিষদ সম্পর্কে অন্যরূপ ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় । যেমন— জনসাধারণ যেখানে চারদিকে (পরি) বসে (সদ্) তাকে বলে পরিষদ; এভাবে লোকেরা যেখানে একসঙ্গে (সম্) বসে (সদ্) তাকে বলে সংসদ । অনুরূপভাবে শিষ্যগণ গুরুর নিকট (উপ) গিয়ে যেখানে বসতেন (নি-√সদ্) মূলত সেই ছোট-ছোট বৈঠকের নাম ছিল উপনিষদ । কালক্রমে এসব বৈঠকে বা উপনিষদে যে বিদ্যার অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যার আলোচনা হতো তারও নাম হয় উপনিষদ । এরপর যে গ্রন্থে এই বিদ্যা লিপিবদ্ধ হলো তার নামও হলো উপনিষদ ।

 

 

 

 

উপনিষদের আরও একটি অর্থ হলো রহস্য । অতিশয় গভীর এবং দুয়ে বলে এই উপনিষদ বা ব্রহ্মবিদ্যাকে সাধারণ বিদ্যার ন্যায় যত্রতত্র সকলের নিকট প্রকাশ করা হতো না তাই এর এক নাম রহস্য। এজন্য উপনিষদ ও রহস্য শব্দ দুটি সমার্থক হয়ে পড়ে। জগতের সর্বকালের অধ্যাত্ম ভাবনার চরমরূপ এই উপনিষদ । প্রতিটি বেদের পৃথক পৃথক উপনিষদ বিদ্যমান । উপনিষদের সংখ্যা দুই শতাধিক। এর মধ্যে বারটি প্রসিদ্ধ উপনিষদ। সেগুলো হলো- ঐতরেয়, কৌষীতকি, বৃহদারণ্যক, ঈশ, তৈত্তিরীয়, কঠ, শ্বেতাশ্বতর, ছান্দোগ্য, কেন, প্রশ্ন, মুণ্ডক ও মাণ্ডূক্য । এর মধ্যে মাণ্ডূক্য ভিন্ন অন্যগুলো শঙ্করাচার্য কর্তৃক ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিধায় এগুলোকে প্রধান উপনিষদ বলা হয় ।

একক কাজ : বেদ ও উপনিষদ সম্পর্কে তিনটি করে বাক্য লেখ ।

পাঠ ৩ : উপনিষদের গুরুত্ব ও শিক্ষা

আগেই বলেছি, বেদের দুটি কাণ্ড । যথা কর্মকাণ্ড ও জ্ঞান কাণ্ড । উপনিষদ জ্ঞান কাণ্ডের অন্তর্গত। কারও কারও মতে, বেদের শেষ লক্ষ্য বা শেষ প্রতিপাদ্য বা শেষ সিদ্ধান্ত এতে সংগৃহীত, সেজন্য এটি বেদান্ত । ব্রহ্মবিদ্যাই বেদের সার, এজন্য এর নাম বেদান্ত এবং অজ্ঞান নিবৃত্তি ও ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায় বলে এর অপর নাম হয়েছে উপনিষদ । অবিদ্যা বা অজ্ঞানকে নাশ করে জ্ঞান ও মুক্তিকামী জীবকে পরমব্রহ্মের নিকটে নিয়ে যায়। পরমব্রহ্মপ্রাপ্তি সাধন বা ব্রহ্মবিদ্যার আলোচনা রয়েছে এ উপনিষদ গ্রন্থসমূহে ।

উপনিষদ বা বেদান্ত রহস্যাবৃত ব্রহ্মবিদ্যার শাস্ত্র । যাঁরা শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে ব্রহ্মনিষ্ঠ ধর্মশাস্ত্রের বাণী শ্রবণ ব্ৰতী হন, একমাত্র তাঁরাই বেদান্ত তত্ত্বকে অন্তরে উপলব্ধি করতে পারেন । উপনিষদগুলো সাধারণত ব্রাহ্মণ ও আরণ্যকের অংশ, তবে ঈশোপনিষদটি সংহিতার সঙ্গে যুক্ত। তাই এটিকে সংহিতোপনিষদ বলা হয়; আর অন্যগুলোকে বলা হয় ব্রহ্মোপনিষদ ।

সাংসারিক জীবনের ধন, মান, প্রতিপত্তির প্রতি বীতস্পৃহ এবং সম্পূর্ণ উদাসীন একশ্রেণির লোক জীবনের প্রকৃত গূঢ় অর্থ নির্ধারণে উৎসুক হয়ে সংসার ত্যাগপূর্বক অরণ্যে বসে গভীর ধ্যান-ধারণা করতেন, তাঁদের চিন্তাপ্রসূত উক্তিগুলোই উপনিষদে স্থান পেয়েছে। তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্যেরা তাঁদের পাদপ্রান্তে বসে শিক্ষালাভ করতেন এবং নিজেরাও গুরুর নিকট লব্ধ জ্ঞানের ও সাধনার অনুশীলন করে এ চিন্তাধারার উৎকর্ষ সাধন করেন ।

উপনিষদের শিক্ষা মানুষকে জীবন বিমুখ করে না, বরং পরিপূর্ণ জীবনের কথা বলে, যে জীবন জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি বা প্রেমের দ্বারা ব্রহ্মের সাথে সর্বদাই যুক্ত । ব্ৰহ্মই সত্য, এ জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্ম ছাড়া কিছুই নয়। জগতের সবকিছুই ব্রহ্মময় উপনিষদের এ উপলব্ধি থেকে বলা হয় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু আছে সবই এক । কারো সাথে কারো কোনো ভেদ নেই । সুতরাং কেউ কাউকে হিংসা করা মানে নিজেকেই হিংসা করা । কারো ক্ষতি করা মানে নিজেরই ক্ষতি করা। অতএব আমাদের সকলেরই উচিত একে অপরকে হিংসা না করে সাহায্য ও সহযোগিতা করা । সকলকে নিজের মতো করে দেখা। আর এভাবেই

 

 

 

 

 

ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, সমাজে, রাষ্ট্রে, সম্প্রদায়ের সাথে সম্প্রদায়ের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে । বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি ।

একক কাজ : সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি কীভাবে গড়ে উঠতে পারে তোমার ভাবনার আলোকে একটি পোস্টার তৈরি কর ।

পাঠ ৪ : উপাখ্যান

আরুণি- শ্বেতকেতু সংবাদ

পুরাকালে আরুণি নামে মহাজ্ঞানী এক ঋষি ছিলেন । শ্বেতকেতু নামে তাঁর এক পুত্র ছিল । শ্বেতকেতুর যখন বার বছর বয়স হলো তখন ঋষি আরুণি তাকে ব্রহ্মচর্য পালনের জন্য গুরুগৃহে প্রেরণ করেন । বার বছর গুরুগৃহে থেকে শ্বেতকেতু সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করে অহংকারী, অবিনীত ও পণ্ডিত হয়ে গৃহে ফিরে এলেন । পিতা তাকে বললেন, ‘শ্বেতকেতু, তুমি ত মহামনা, পণ্ডিত হয়ে ফিরে এসেছ। কিন্তু তুমি কি সেই আদেশের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলে, যাতে অশ্রুত বিষয় শোনা যায়, অচিন্তিত বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায়?' শ্বেতকেতু বললেন, 'ভগবান, কি সেই উপদেশ?' পিতা বললেন, “হে সৌম্য! একটি মৃৎপিণ্ডকে জানলেই সমস্ত মৃন্ময় বস্তু সম্পর্কে জানা যায়। কারণ একটা ঘট একটা সরা, ইত্যাদি মৃত্তিকার বিকার মাত্র । ভাষা দ্বারা পার্থক্য না করলে সবই মৃত্তিকা। অনুরূপ একটি সুবর্ণপিণ্ডকে জানলেই সকল সুবর্ণময় বস্তুকে জানা যায়। কুণ্ডল, বলয় প্রভৃতি সুবর্ণের বিকার মাত্র। প্রকৃতপক্ষে সুবর্ণই সত্য । এসবই মৃত্তিকার বা সুবর্ণের বিকার ছাড়া কিছুই নয় । মৃত্তিকা বা সুবর্ণই সত্য । তেমনি হে শ্বেতকেতু, সেই উপদেশ শ্রবণ করলে অশ্রুত বিষয় শোনা হয়, অচিন্তিত বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায় ।' শ্বেতকেতু বললেন, ‘পূজনীয় উপাধ্যায়গণ নিশ্চয়ই এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না । যদি অবগত হতেন, তবে বললেন না কেন?

সুতরাং আপনি আমাকে এ বিষয়ে উপদেশ দিন।' আরুণি বললেন, “হে সৌম্য, তা-ই হোক।' আরুণি বলতে লাগলেন- শোন, এ জগৎ পূর্বে এক ও অদ্বিতীয় সরূপেই বিদ্যমান ছিল । তিনি চিন্তা করলেন, ‘বহু স্যাম’ অর্থাৎ বহু হব । তারপর তিনি তেজ সৃষ্টি করলেন । তেজ থেকে জল উৎপন্ন হলো । জল থেকে অন্ন সৃষ্টি হলো । এজন্যই যেখানে বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে বহু অন্ন জন্মে । অন্ন থেকে মন, জল থেকে প্রাণ এবং তেজ থেকে বাক্-এর উৎপত্তি । শ্বেতকেতু বললেন,- 'আপনি আমাকে বুঝিয়ে দিন।' আরুণি বললেন, ‘শোন, পুরুষ ষোলকলা যুক্ত । পনের দিন ভোজন করো না, কিন্তু যতটা ইচ্ছা জল পান করো, কারণ প্রাণ জলময় । জলপান করলে প্রাণ বিয়োগ হয় না ৷'

 

 

 

 

শ্বেতকেতু পনের দিন ভোজন করলেন না। তারপর পিতার নিকট গিয়ে বললেন, 'পিতা, আমি কি বলব?” পিতা বললেন, “ঋক্, যজু ও সাম মন্ত্র উচ্চারণ কর।' শ্বেতকেতু বললেন, ‘ঐ সব আমার মনে আসছে না।' আরুণি বললেন,- 'সৌম্য পনের দিন অনাহারে থেকে তোমার ষোলটি কলার মাত্র একটি কলা অবশিষ্ট আছে । এর দ্বারা বেদ সমূহ বুঝতে পারছ না। তুমি আহার কর । পরে আমার কথা বুঝতে পারবে ।'

শ্বেতকেতু ভোজন করে পিতার নিকট গেলেন। পিতা তাঁকে যা কিছু বললেন, তিনি সে সবই আনায়াসে বুঝলেন। তিনি বললেন, হে সৌম্য, জল ভিন্ন দেহের মূল কোথায়? জলরূপ অঙ্কুরদ্বারা কারণরূপ তেজকে অন্বেষণ কর । বিশ্ব চরাচর এ সবই সৎ থেকে উৎপন্ন, সৎ-এ আশ্রিত ও সৎ-এ লীন হয়। এই সৎ বস্তুই আত্মা।

শ্বেতকেতু বললেন, 'হে পিতা, বুঝতে পারলাম না ।' আরুণি বললেন, 'হে সৌম্য, এ আত্মাকে জানতে পারলেই ব্রহ্মকে জানা যায় । কারণ, 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’-

অর্থাৎ সব কিছুই ব্রহ্মময় ।

শ্বেতকেতু বললেন, “তাহলে আপনি কে?’

আরুণি বললেন, 'ব্রহ্মাস্মি- অর্থাৎ আমি ব্রহ্ম ।

শ্বেতকেতু – তাহলে, আমি কে?

 

 

আরুণি— ‘তত্ত্বমসি অর্থাৎ তুমিই সেই (ব্রহ্ম) ।'

শ্বেতকেতু— যদি আমি, আপনি এবং জগতের সবকিছুই ব্রহ্মময় তাহলে আমরা তাকে দেখতে পাই না কেন? তখন আরুণি শ্বেতকেতুকে এক গ্লাস জলে এক চামচ লবণ রেখে পরের দিন আসতে বললেন । শ্বেতকেতু তাই করলেন । পরের দিন সকালে আরুণি শ্বেতকেতুকে বললেন, “কাল যে লবণ রেখেছিলে, তা আন ।’ শ্বেতকেতু লবণ খুঁজে পেলেন না । আরুণি শ্বেতকেতুকে বললেন, গ্লাস থেকে জল পান কর । শ্বেতকেতু জলপান করলেন।

আরুণি বললেন, 'কি রকম?’

শ্বেতকেতু বললেন, ‘লবণাক্ত ।’

আরুণি বললেন, ‘হে শ্বেতকেতু, লবণ জলে লীন হয়ে আছে; তাই দেখা যায় না । কিন্তু সর্বদা জলের সর্বত্র বিদ্যমান । অনুরূপভাবে ব্রহ্ম সর্বদা সকল স্থানে বিদ্যমান, তাকে আমরা দেখতে পাই না । কিন্তু জানা যায়। এ ব্রহ্মই জানার বিষয় । তিনিই সৎ, তিনিই আত্মা । আর এই ব্রহ্মকে জানা মানে আত্মাকে জানা, নিজেকে জানা । এটাই প্রকৃত জ্ঞান ।’

উপাখ্যানের শিক্ষা

‘জগতের সব কিছুই ব্রহ্মময়' উপনিষদের এ উপলব্ধি থেকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু আছে সবকিছুকে ব্রহ্মজ্ঞান করা উপনিষদের শিক্ষা । জীবের মধ্যে আত্মারূপে ব্রহ্ম অবস্থান করেন । তাই কারও সাথে কারও কোনো ভেদ নেই; কেউ কাউকে হিংসা করা মানে নিজেকেই হিংসা করা । কারও ক্ষতি করা মানে ব্রহ্মের ক্ষতি করা। সুতরাং আমাদের সকলেরই উচিত একে অপরকে হিংসা না করে সাহায্য ও সহযোগিতা করা ।

পাঠ ৫ : ধর্মাচরণ এবং মূল্যবোধ ও নৈতিকতা গঠনে রামায়ণের শিক্ষা

রামায়ণ আদি কবি বাল্মিকী মুনি রচিত। রামায়ণকে বলা হয় আদিকাব্য। রামায়ণ অন্যতম প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ । মূল রামায়ণ সংস্কৃত ভাষায় রচিত । কৃত্তিবাস বাংলায় রামায়ণ অনুবাদ করেন । এ ধর্মগ্রন্থে আছে আদর্শ রাজার কথা। আছে ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয়ের কথা । আছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের কথা । এখানে আছে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা গঠনের শিক্ষামূলক নানা কাহিনি ও উপাখ্যান । এ সকল আখ্যান ও উপাখ্যান আমাদের ধর্মাচরণে উদ্বুদ্ধ করে, মূল্যবোধ সৃষ্টিতে প্রেরণা যোগায় আর নৈতিকতা গঠনে শিক্ষা দেয়।

কৃত্তিবাসের রামায়ণে রত্নাকর দস্যুর কাহিনি থেকে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, যদি কেউ পাপ কার্য করে, সেটার ফল তাকেই ভোগ করতে হবে । পিতা-মাতা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউই তার ভাগীদার হবে না। দস্যু রত্নাকর ব্রহ্মার উপদেশ গ্রহণ করে একজন ঋষিতে পরিণত হন । শুধু উপদেশ প্রদানই নয়, গ্রহণ করার মানসিকতাও গুরুত্বপূর্ণ । এ কাহিনিটি আমাদের উপদেশ গ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং আমাদের

 

 

 

 

উচিত সদা সৎপথে চলা, সত্য কথা বলা, মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করা, কাউকে দুঃখ না দেয়া । ধর্মগ্রন্থসমূহে মানুষের যাতে আত্মিক উন্নতি হয়, নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে, এ সব কথাই বর্ণিত হয়েছে । রামায়ণে রয়েছে পিতার প্রতি পুত্রের কর্তব্যের কথা, ভ্রাতৃপ্রেম, পতিপ্রেমের পরাকাষ্ঠা, দেশপ্রেমে নিষ্ঠা, প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি কনিষ্ঠ ভ্রাতার কর্তব্য ও আনুগত্য প্রকাশ। যেমন- রাজা দশরথের সত্যরক্ষা করতে রামের রাজত্ব ত্যাগ ও চৌদ্দ বৎসরের জন্য বনবাসে গমন । রামের সাথে সীতা ও লক্ষ্মণের বনবাস গমন- পতিপ্রেমের পরাকাষ্ঠা ও ভ্রাতৃপ্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ ।

বনবাসের কালে লঙ্কার রাজা রাবণ কর্তৃক সীতা হরণ এবং রাম কর্তৃক লঙ্কা আক্রমণ ও রাবণকে সবংশে নিধন করে সীতাকে উদ্ধার করা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এবং সত্যের জয়েরই প্রমাণ হয়েছে । মাতা কৈকেয়ীর আচরণে ভরত ক্ষুব্ধ হয়ে বড়ভাই রামকে ফিরিয়ে আনতে বনে গমন করেন । রাম ফিরে না এলে ভরত তার পাদুকা নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং রামের নামে রাজ্য পরিচালনা করেন । ভরত রাজা হয়েও ভোগবিলাসে জীবনযাপন করেন নি । রাজসিংহাসনে বসেও বড়ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার বশবর্তী হয়ে বনবাসীর মতো জীবনযাপন করেছেন। ভরত ও লক্ষ্মণের আচরণে আমরা ভ্রাতৃপ্রেমের শিক্ষা লাভ করি ।

রামায়ন

রাম ছিলেন আদর্শ রাজা। তাঁর রাজত্বে কেউ কখনো কোনরূপ দুঃখ ভোগ না করে এ ব্যাপারে তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন । তিনি তাঁর স্ত্রী সীতাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি সীতাকে ত্যাগ করতেও দ্বিধা করেন নি। এতে রাজার কর্তব্য সম্বন্ধে আমরা শিক্ষা লাভ করে থাকি । রামের রাজত্ব সম্পর্কে প্রবাদ আছে যে, রামের মতো রাজা কখনো ছিল না এবং ভবিষ্যতেও হবে না। তাই ধর্মাচরণের পাশাপাশি আমাদের ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ শ্রদ্ধাভরে পাঠ করা এবং রামায়ণের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত ।

পাঠ ৬ : ধর্মাচরণ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা গঠনে মহাভারতের শিক্ষা মহাভারত অন্যতম প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেন। মূল মহাভারত সংস্কৃত ভাষায় রচিত । কাশীরাম দাস বাংলায় মহাভারত অনুবাদ করেন । মহাভারতের বিষয়বস্ত্র কৌরব ও পাণ্ডবদের যুদ্ধের কাহিনি। কুরুক্ষেত্রে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে প্রমাণ হয়েছে ‘যথা-ধর্ম তথা-জয়' । কৌরব ও পাণ্ডবদের যুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত হলেও এ গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে নানা আখ্যান-উপাখ্যান । এ সমস্ত আখ্যান উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে ধর্মের কথা । ধার্মিকের কথা, ধার্মিকগণের সাময়িক দুঃখ-কষ্টের পর পরিণামে তাদের সার্বিক মঙ্গলের কথা। আর আছে অধর্মের কথা, অধার্মিকের কথা এবং পরিণামে তাদের পরাজয় ও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা । মহাভারতে এ রকম বহু কাহিনি উপকাহিনি রয়েছে। এ সমস্ত কাহিনি উপকাহিনি মানুষকে ধর্মের পথে পরিচালিত করে । মানুষকে অধর্ম ও অন্যায় পথ পরিহার করতে শিক্ষা দেয় । 

 

 

 

মানুষের মনে নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে। সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। এ জন্য সকলেরই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে— ‘যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে।' অর্থাৎ ভারতবর্ষে এমন কোনো ঘটনা নেই যা মহাভারতে বিবৃত হয়নি । মহাভারতে কুরু-পাণ্ডবের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূলে রয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার দম্ভ, রাজনীতির কূটকৌশলের আশ্রয়ে যেনতেন প্রকারে প্রতিপক্ষের ক্ষতিসাধন করা এবং ন্যায়, ধর্ম ও সত্যকে পরিহার করে অন্যকে তাঁর ন্যায্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা । তাই আমরা দেখি মহাভারতে দুর্যোধনের সকল চক্রান্ত ব্যর্থ করে ধর্মের জয় হয়েছে, সত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে; কুরু বংশ ধ্বংস হয়েছে, পাণ্ডবগণ তাঁদের হৃতরাজ্য উদ্ধার করে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন । এতে প্রমাণ হয়েছে যাঁরা ধার্মিক ও ন্যায়ের পথে থাকে ভগবান তাঁদের সাহায্য করেন । আর যাঁরা অধর্ম ও অন্যায়ভাবে অপরের বস্তু কেড়ে নিতে চায় ভগবান তাঁদের ক্ষমা করেন না। সাময়িকভাবে তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি, ক্ষমতার দম্ভ দেখা গেলেও পরিণামে তাঁদের পতন অনিবার্য । মহাভারতে যে সমস্ত আখ্যান উপাখ্যান সন্নিবেশিত হয়েছে, তাতে হিংসার বিষময় ফল আর অহিংসার যে শুভ ফলপ্রাপ্তি তার প্রতিফলন ঘটেছে ।

মহাভারত পাঠ করে আমরা রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব, মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা গঠনে উদ্বুদ্ধ হই । মহারাজ পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয়কে তাঁর পূর্বপুরুষের বৃত্তান্ত বলতে গিয়ে মহামতি ব্যাসদেব এ মহাভারত বর্ণনা করেছেন । প্রসঙ্গক্রমে এসেছে নানা কাহিনি উপকাহিনি । এসকল কাহিনির দ্বারা তৎকালীন সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষ, মানবিকতা, সকলই বর্ণনা করা হয়েছে । এখানে বর্ণনা করা হয়েছে— রাজার কর্তব্য, প্রজাপালন, অতিথি সেবা, ক্ষমতার চেয়ে ভক্তির উৎকর্ষতার প্রমাণ। বারবার প্রমাণ হয়েছে— ‘রাখে হরি মারে কে', অর্থাৎ হরি যাকে রক্ষা করেন, কেউ তাকে ধ্বংস করতে পারে না । তাই মহাভারত পাঠে আমরা ধর্মাচরণে উদ্বুদ্ধ হই, মানবিকতা ও নৈতিকতা শিক্ষা লাভ করি, জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার প্রয়াস পাই। সুতরাং আমাদের উচিত মহাভারত অধ্যয়ন করা এবং এর মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করা ।

নতুন শব্দ : শ্রেয়, প্রেয়, অনুশাসন, আত্মিক, সরা

 

অনুশীলনী

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

১। বৃহদারণ্যক উপনিষদ কোন বেদের অন্তর্গত?

ক. শুক্লযজুর্বেদ

গ. সামবেদ

খ. কৃষ্ণযজুর্বেদ

ঘ. ঋকবেদ

২। শ্বেতকেতু কত বছর গুরুগৃহে ছিলেন?

ক. দশ

খ. বার

গ. চৌদ্দ

ঘ. ষোল

 

 

 

৩। রত্না শিক্ষকের উপদেশমত মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করে এবং পরীক্ষায় সাফল্য

লাভ করে । রত্নার আচরণে প্রকাশ পেয়েছে –

i. আনুগত্য

ii. উপদেশ গ্রহণের মানসিকতা iii. ভালো ফলের আকাঙ্ক্ষা

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i ও ii

গ. i ও iii

খ. ii ও iii

ঘ. i, ii ও iii

নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৪ ও ৫ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও :

শ্রেয়সীর বাবা একজন শিল্পপতি । তিনি সত্যনিষ্ঠ ও ধার্মিক । তিনি সবসময় শ্রমিক ও কর্মচারীদের সুবিধা-অসুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখেন এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করেন । তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করেন এবং কথা দিলে তা রাখার চেষ্টা করেন । শ্রেয়সীও কখনও বাবার অবাধ্য হয় না । সে বাবার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করার জন্য যে কোনো কাজ করতে প্রস্তুত থাকে ।

৪ । শ্রেয়সীর চরিত্রে তোমার পঠিত কোন অবতারের আচরণের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়?

ক. শ্ৰীকৃষ্ণ

খ. রামচন্দ্র

গ. শ্রীচৈতন্য

ঘ. বলরাম

৫। শ্রেয়সীর আচরণে প্রকাশ পায় –

i. ভালোবাসা

ii. পিতৃভক্তি

iii. অনুকম্পা

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i

খ. ii

গ. i ও ii

ঘ. i, ii ও iii

সৃজনশীল প্রশ্ন :

১। অমিয় তার বন্ধুদের নিয়ে একটি সমিতি গঠন করে নানা প্রকার সমাজসেবামূলক কাজের পাশাপাশি শিশুদের একটি অনাথ আশ্রম পরিচালনা করে । আশ্রমের জন্য তাঁরা চাঁদা দেয় । কখনও বা প্রয়োজনে জোর করে চাঁদা তোলে কিংবা চুরি করে প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও টাকা সংগ্রহ করে । কারণ সে মনে করে অনাথ শিশুগুলোকে বাঁচাতে হলে সবসময় ন্যায়-অন্যায় বিচার করলে চলবে না । কিন্তু

 

 

 

অমিয়র বাবা বলেন, 'চুরি করা বা জোর করে চাঁদা আদায় উচিত নয়, সৎপথে উপার্জনের মাধ্যমেই

ভালো কাজ করতে হয়'।

ক. কোন্ গ্রন্থ পাঠ করলে ধর্মের লক্ষণগুলো সম্বন্ধে জানা যায়?

খ. নৈতিকতা গঠনে উদ্দীপকের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর ।

খ. অমিয়র আচরণে ধর্মের যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেয়েছে তা তোমার পঠিত বিষয়ের আলোকে ব্যাখ্যা কর। ঘ. ‘অমিয়র বাবার উপদেশ নৈতিকতা গঠনে একান্ত সহায়ক’- তোমার পঠিত বিষয়ের আলোকে কথাটি মূল্যায়ন

কর।

২ । মিতালীর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি দেখে শিক্ষক তাকে শ্রেণি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেন। কিছু শিক্ষার্থী মিতালীকে সমর্থন জানালে তাদের সহযোগিতায় মিতালী যোগ্যতার সাথে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করে । এতে শিক্ষক এবং অধিকাংশ শিক্ষার্থীই খুশী । কিন্তু প্রিতম ও কিছু শিক্ষার্থী এটা মেনে নিতে না পারায় তাদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা হয় । তারা মিতালীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়ালে শিক্ষক মিতালীকে সরিয়ে প্রিতমকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু পরে প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে মিতালীকে দায়িত্বে ফিরিয়ে দেন এবং অভিযোগকারীদের সংশোধন হতে বলেন ।

ক. কে বাংলায় মহাভারত অনুবাদ করেন?

খ. মহাভারতে কুরু ও পাণ্ডবদের যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ কেন বুঝিয়ে লেখ।

গ. অনুচ্ছেদে বর্ণিত প্রিতমের আচরণিক বৈশিষ্ট্য তোমার পঠিত মহাভারতের বিষয়বস্তুর কোন চরিত্রের

প্রতিফলন ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. অনুচ্ছেদের ঘটনায় বর্ণিত শিক্ষকের ভূমিকা তোমার পঠিত মহাভারতের বিষয়বস্তু শিক্ষার আলোকে মূল্যায়ন কর।

Content added By